দুর্গাপূজা কেন সর্বজনীন উত্সব
‘শিশিরে শিশিরে শারদ আকাশে ভোরের আগমনী। সোনার আলোয় জাগবে পৃথিবী, বাজবে আলোর বাঁশি। আকাশ পটে মহামায়ার ভুবনমোহিনী হাসি’। এই ভুবনমোহিনী হাসির অন্তরালে রয়েছে দেবী দুর্গার মহিষাসুর বধের কাহিনী।
পুরাণ অনুসারে, মহিষাসুর নামক
অসুরের অত্যাচারে স্বর্গ, মর্ত্য এবং পাতাল — সব জগৎ কাঁপছিল। তখন ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বর তাঁদের শক্তি একত্রিত করে
দেবী দুর্গাকে সৃষ্টি করেন। রণদেবী দুর্গা মহিষাসুরের
বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তাঁকে বধ করেন এবং শুভশক্তির প্রতিষ্ঠা করেন। দুর্গাপূজা সেই বিজয়কেই স্মরণ করে।
‘অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে শুভ শক্তির যুদ্ধ’ একটি সর্বজনীন এবং চিরন্তন বিষয়, যা প্রাচীন
পুরাণ থেকে আধুনিক সমাজ পর্যন্ত বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রূপে উঠে এসেছে। অর্থাত্ এই ধারণাটি শুধু ধর্মীয় ও পৌরাণিক কাহিনীতে সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি আমাদের
দৈনন্দিন জীবনের নৈতিক এবং সামাজিক বাস্তবতায়ও প্রাসঙ্গিক।
আজকের সামাজিক, রাজনৈতিক এবং
অর্থনৈতিক পরিস্থিতির আলোকে ‘অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে শুভ শক্তির যুদ্ধ’কে নতুনভাবে
নির্ণয় করা যেতে পারে। যেমন, অন্যায়, দুর্নীতি, অত্যাচার এবং বৈষম্যের
বিরুদ্ধে যে সমস্ত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কাজ করে, তারা শুভ শক্তির প্রতিনিধি। সমাজে নারীর প্রতি সহিংসতা, শিশু নির্যাতন অশুভ শক্তির প্রতীক। ধর্ম, বর্ণ, জাতি, জেন্ডার ভিত্তিক
বৈষম্য এক ধরনের অশুভ শক্তি। এই সমস্ত সমস্যার বিরুদ্ধে
সচেতনতা, প্রতিবাদ এবং
আইনি পদক্ষেপ হল শুভ শক্তির প্রতিফলন।
সুতরাং, ‘অশুভ শক্তির
বিরুদ্ধে শুভ শক্তির যুদ্ধ’ কেবল হিন্দুদের ধর্মীয় বা পৌরাণিক আখ্যানেই নয়, সব মানুষের বাস্তব
জীবনেও প্রতিফলিত হয়। আর তাই বলা যায়, দুর্গাপূজার
মূল ভাব সর্বজনীন, সকলের পক্ষে হিতকর। সম্ভবত এটাও একটি কারণ, যে জন্য ইউনেস্কো দুর্গাপূজাকে ‘ইনট্যানজিবল
কালচারাল হেরিটেজ অব হিউম্যানিটি’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।
অতএব দুর্গাপূজা হিন্দুদের বিষয় হলেও এই উৎসবের মর্মকথা — ‘অশুভ শক্তির দমন এবং শুভ শক্তির প্রতিষ্ঠা’ — একটি বিশ্বজনীন বিষয়। যা বিশ্বের সব সমাজেই প্রাসঙ্গিক। সুতরাং, দুর্গাপুজোর ক্ষেত্রে সঙ্গত কারণেই বলা যেতে পারে — ‘ধর্ম যার যার, উত্সব সবার’।▣