ফিরে দেখা: একটি জীবনের পাণ্ডুলিপি

আর একটি বসন্ত খসে পড়ল বরাদ্দ সময় থেকে। পার হয়ে গেল আরও একটি বছর। আর একটি নববর্ষ ধরা দিল উৎসবের আলোয়। ক্যালেন্ডারের পাতায় যতই নতুন সংখ্যা যোগ হোক, আমাদের জীবনের ঘড়িতে একটুখানি সময় ফুরিয়ে যায় চুপিচুপি। এইভাবেই ধাপে ধাপে এগিয়ে চলে জীবন — এক অনিবার্য, অপরিবর্তনীয় গন্তব্যের দিকে

তবু প্রশ্ন থেকেই যায় — জীবন কি কেবল গন্তব্যের দিকে ধাবমান এক যাত্রা? যদি গন্তব্য একদিন পৌঁছানোর জন্যই নির্ধারিত থাকে, তাহলে তো যাত্রাই অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই যাত্রার মধ্যেই গাঁথা থাকে জীবনের আসল গল্প — যেগুলো কখনও আনন্দে পূর্ণ, আবার কখনও গাঢ় বিষাদের রঙে রাঙানো। যাত্রাপথেই মানুষ খুঁজে পায় চেনা-অচেনা রূপ, হারায় ও ফিরে পায় নিজেকে বারবার

জীবনের প্রারম্ভে মানুষ এক অনন্য অভিযাত্রায় পা রাখে — শিশুর প্রথম কাঁদা, প্রথম হাঁটা, প্রথম কথা বলা। সে শেখে; তার চারপাশের জগৎটাকে চিনতে শেখে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তার শরীর হয় বলিষ্ঠ, মন হয় কৌতূহলী। জীবনের প্রথম পর্বে সে সংগ্রহ করে জ্ঞান, অভিজ্ঞতা, সম্পর্ক। সে স্বপ্ন দেখে, সেই স্বপ্নের পেছনে ছুটে চলে ক্লান্তিহীন

কিন্তু পরিবর্তন প্রকৃতির শাশ্বত নিয়ম। সময়ের দ্বিতীয়ার্ধে শুরু হয় আর এক ভিন্ন অভিজ্ঞতা — পশ্চাদগমন। শরীর, যে একসময় ছিল তার সবচেয়ে বড় ভরসা, ধীরে ধীরে হয়ে ওঠে দুর্বল। চোখের দৃষ্টি ম্লান হয়, শ্রবণশক্তি কমে আসে, পেশি আর হাড়ের বল হারিয়ে যেতে থাকে ধীরে ধীরে। মুখের রেখায় জমা হতে থাকে কালের চিহ্ন। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে একদিন নিজেকেই অচেনা মনে হয়

আর ঠিক তখনই, যখন মনের প্রজ্ঞা পৌঁছে যায় তার শিখরে, অভিজ্ঞতার ভান্ডার হয় সমৃদ্ধ — শরীর হয়ে ওঠে বিশ্বাসঘাতক। এ যেন জীবনের এক নির্মম পরিহাস, যেখানে সবচেয়ে মূল্যবান উপলব্ধির সময়েই মানুষকে সবচেয়ে বেশি পরনির্ভর হতে হয়

এই দ্বন্দ্বের ভেতরেই মানুষ ফিরে তাকায় পেছনের দিকে — সেই দিনগুলোর দিকে, যখন তার মধ্যে ছিল অফুরন্ত শক্তি, আগুনের মত আত্মবিশ্বাস। সে বিস্ময়ে ভাবে: ‘আমি কি একদিন এতটাই সক্রিয় ছিলাম? কোথায় গেল সেই দিনগুলো, সেই উচ্ছ্বাস, সেই স্ফূর্তি?

Sunset at Puslinch Lake
গাও অস্তসূর্যের জয়গান

তবু জীবনের গোধূলিলগ্নে যে আত্মজাগরণ ঘটে, তা কেবল স্মৃতির ভার নয় — বরং এক অন্তর্দৃষ্টি, যা জীবনের সার্থকতা ও ব্যর্থতার ঊর্ধ্বে উঠে দাঁড়ায়। সেই সময়ে মানুষ আবিষ্কার করে, সমস্ত প্রাপ্তি আর অপূর্ণতা আসলে এক বিশাল কাব্যের ভিন্ন ছন্দ মাত্র — যার সুর একান্তই তার নিজের। সেখানে দ্বন্দ্ব আর যন্ত্রণার পেছনে মুখ তুলে দাঁড়ায় করুণার আলো, এবং ক্লান্তির সীমায় এসে জেগে ওঠে এক মৌন গ্রহণযোগ্যতা — যা রাগ বা অনুতাপ নয়, বরং নির্বিচারে মেনে নেওয়া জীবনের সমস্ত প্রবাহকে।

এই উপলব্ধির গভীরতাতেই ধ্বনিত হয় এক অনন্ত সত্য:

আছে, আছে, আছে” —
এই অনুভবের গভীরে মিশে থাকে
নক্ষত্রের নিরব চলন,
রাত্রির অন্তর্লীন গল্প,
সিন্ধুর অনন্ত গর্জন,
রীতির মাধুর্য,
আর মানুষের হৃদয়ের অবিনশ্বর স্পন্দন

জয় হোক অস্তসূর্যের — যে চলে গিয়ে নতুন দিনের প্রতিশ্রুতি রাখে
জয় হোক অলখ অরুণোদয়ের — যে অদৃশ্য থেকেও আলো জাগায় মনে

জয় হোক জীবনের — যাত্রার, উপলব্ধির, এবং চূড়ান্ত আত্মসমর্পণের 

Comments

Popular posts from this blog

দুর্গাপূজা কেন সর্বজনীন উত্‍সব