ফ্যাসিবাদ — এক সর্বনিয়ন্ত্রণবাদী মতবাদ
ফ্যাসিবাদ হল এমন এক সর্বনিয়ন্ত্রণবাদী রাজনৈতিক মতবাদ, যা সমাজ ও রাষ্ট্রের সমস্ত বিষয় নিয়ন্ত্রণ করে এবং কোনও বিরোধিতা সহ্য করে না। এটি সাধারণত কর্তৃত্ববাদ ও একনায়কতন্ত্রের পক্ষে অবস্থান নিয়ে গণতন্ত্র ও মুক্ত মতপ্রকাশের বিপক্ষে থাকে। ঐতিহাসিকভাবে, ইতালিতে বেনিতো মুসোলিনি ফ্যাসিবাদের প্রবক্তা ছিলেন এবং পরবর্তীতে আডলফ হিটলারের নেতৃত্বে নাৎসি জার্মানিতে ফ্যাসিবাদ ভয়াবহ রূপ নেয়।
ফ্যাসিবাদের উৎপত্তি
‘ফ্যাসিস্ট’ শব্দটি এসেছে "fascio" থেকে, যার অর্থ ইতালীয় ভাষায় "আঁটি"।
প্রাচীন রোমে ‘ঐক্যের মাধ্যমে শক্তি’র প্রতীক হিসেবে গাছের সরু ডালের আঁটি ব্যবহৃত
হত। এই সূত্র ধরেই বেনিতো মুসোলিনি ‘একতাই শক্তি’ বার্তা দিতে ফ্যাসিস্ট শব্দটি
উদ্ভাবন করেন। তিনি 1921 সালে ন্যাশনাল ফ্যাসিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠা করেন, যা জাতীয় ঐক্যের
কথা বলে এবং বিরোধীদের দমন করতে প্রয়োজনে শক্তি প্রয়োগ করে। মুসোলিনি মূলত
সমাজতন্ত্রীদের ঘৃণা করতেন এবং তাঁর ফ্যাসিবাদী সহিংসতার লক্ষ্য ছিল
সমাজতন্ত্রীদের শাস্তি দেওয়া। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় সমাজতন্ত্রীরা ইতালিকে
সমর্থন করেনি, যা মুসোলিনির ক্রোধের অন্যতম কারণ।
মুসোলিনির
প্রভাব
ন্যাশনাল
ফ্যাসিস্ট পার্টি 1922 থেকে 1943 পর্যন্ত ইতালি শাসন করে, যখন মুসোলিনি
ছিলেন প্রধানমন্ত্রী। আজও মুসোলিনির নাম স্মরণ করা হয় একজন ভয়ংকর একনায়ক হিসেবে, যদিও ইতালিতে
বহু মানুষ তাঁকে বীর হিসেবে শ্রদ্ধা করে। কারণ তিনি বেকারত্ব কমিয়েছিলেন, জাতীয় অর্থনীতির
উন্নতিসাধন করেছিলেন এবং জনগণের জন্য অসামান্য পরিকাঠামো তৈরি করেছিলেন। মুসোলিনি
ইতালীয় জাতীয়তাবাদের প্রচার করেন, সাবেক গৌরব পুনরুদ্ধার এবং রোমান সাম্রাজ্য
পুনরুজ্জীবিত করার কথা বলেন।
যুদ্ধ-পরবর্তী
ইতালির মানুষের মনে মুসোলিনির সরকার এক ধরনের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার বোধ
জাগিয়েছিল। মা ও শিশু স্বাস্থ্যসেবার ব্যাপক উন্নতি করেছিলেন, কারণ তিনি
জনসংখ্যা বৃদ্ধি করতে চেয়েছিলেন যাতে বৃহৎ সেনাবাহিনী গঠন করা যায়। মুসোলিনি
তাঁর মন্ত্রিসভা এবং সংসদ সদস্যদের তুলনায় অনন্য প্রতিভা ও ব্যক্তিত্বের অধিকারী
ছিলেন, যারা কখনও তাঁর
সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করতেন না। এভাবেই তিনি সর্বময় ক্ষমতাপ্রাপ্ত শাসক হয়ে
ওঠেন। মুসোলিনি কোনও দিনই একনায়ক ছিলেন না, তাঁকে বলা যেতে পারে কর্তৃত্ববাদী
প্রধানমন্ত্রী। তিনি পদ হারিয়েছিলেন মন্ত্রীপরিষদের অনাস্থা ভোটে যখন যুদ্ধে
পরাজয় স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। যদি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তিনি জড়িয়ে না পড়তেন, তাহলে তিনি আরও
বহু দিন ক্ষমতায় থাকতে পারতেন।
ফ্যাসিবাদের
বৈশিষ্ট্য
ফ্যাসিবাদী
ব্যবস্থাকে ন্যায্যতা দিতে সাধারণত ব্যবহৃত হয় জাতীয়তাবাদ — বিশেষ একটি জাতির
শ্রেষ্ঠত্বের ধারণা। জাতীয়তাবাদ হতে পারে জাতিগত, বর্ণগত কিংবা ধর্মীয়।
ফ্যাসিবাদী সরকারের কিছু বৈশিষ্ট্য হল:
• নিজেদের আদর্শকে শক্তি দিয়ে প্রয়োগ করা
• বিরোধী মতাবলম্বীদের দমনে কঠোর নীতি গ্রহণ করা
• রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে হিংসাত্মক উপায়ে নির্মূল
করা
• হিংসাকে মহিমান্বিত করা
• কর্তৃত্ববাদী নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা এবং
গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান প্রত্যাখ্যান করা
উপসংহার