আকাশ-পৃথিবীর বিরহ

আকাশ আর পৃথিবীর সম্পর্কটি প্রণয়ের, আবার চিরবিরহের। এ সম্পর্কের উল্লেখ পাওয়া যায় বিভিন্ন দেশের প্রাচীন পুরাণকাহিনিতে। অধিকাংশ পুরাণে আকাশ পুরুষ এবং পৃথিবী নারী হিসেবে কল্পিত হয়েছে। ভারতীয় পুরাণ অনুসারে, পৃথু নামে এক রাজা ছিলেন, যিনি প্রথম সত্যিকারের রাজা হিসেবে পরিচিত। তিনি পৃথিবীর ভূমিকে সমতল করেছিলেন। অথর্ববেদে বলা হয়েছে, পৃথু লাঙ্গল দিয়ে চাষ শুরু করেছিলেন এবং কৃষির আবিষ্কার তাঁরই কৃতিত্ব। পৃথুর স্ত্রীর নাম পৃথ্বী। এখান থেকেই আমাদের গ্রহের নাম হয়েছে পৃথিবী’, যা নারীরূপে কল্পিত।

তবে মিশরীয় পুরাণে এর ঠিক উল্টো। সেখানে আকাশ নারী এবং পৃথিবী পুরুষ।

মিশরীয় পুরাণ অনুসারে, পৃথিবী সৃষ্টির পর ঈশ্বর পৃথিবীকে রক্ষার জন্য কয়েকজন দেব-দেবী প্রেরণ করেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন আকাশের দেবী নুট, পৃথিবীর দেবতা জেব এবং বায়ুদেবতা শু।

Nut-Zeb-Shu
নুট-জেব-শু

নুট প্রথমে ছিলেন রাতের আকাশের দেবী, কারণ তখনও সূর্যের জন্ম হয়নি, ফলে দিনও ছিল না। সূর্যের জন্মের পর নুট পুরো আকাশের দায়িত্ব পান। নুট শব্দের অর্থ রাত্রি। ধারণা করা হয়, এখান থেকেই ইংরেজি শব্দ নাইট এসেছে। নুটের গায়ের রঙ ছিল নীল, আর তাঁর শরীর ছিল নক্ষত্রখচিত। বায়ুদেবতা শু তাঁর দুই হাত দিয়ে নুটকে ওপরে তুলে ধরেন। নুট ধনুকের মতো বাঁকা হয়ে আকাশটিকে নিজের পিঠে ধরে রেখেছেন। তাঁর হাত ও পায়ের আঙুল মাটিকে স্পর্শ করছে, আর নীচে মাটিতে হেলান দিয়ে বসে আছেন পৃথিবীর দেবতা জেব। তাঁকে দেখে মনে হয় ভূপৃষ্ঠের উঁচু-নিচু ভূমি — পাহাড় ও উপত্যকা।

নুট ও জেব একে অপরের প্রতি গভীরভাবে প্রণয়াসক্ত ছিলেন। তাঁদের প্রেম এতটাই গভীর ছিল যে, তাঁরা এমনভাবে জড়িয়ে থাকতেন যে, তাঁদের মাঝে কিছুই আসতে পারত না। কিন্তু বায়ুদেব শু তাঁদের সম্পর্ক দেখে ঈর্ষান্বিত হন। একদিন তিনি নুট ও জেবকে বিচ্ছিন্ন করে দেন। দুই হাত দিয়ে নুটকে ওপরে ঠেলে দেন, আর জেব পড়ে রইলেন নীচে — মাটিতে। তখন আকাশ ও পৃথিবীর মাঝে শূন্য স্থান সৃষ্টি হয়, শুরু হয় বায়ুর প্রবাহ।

এই বিচ্ছেদ ঘটলেও নুট তখন গর্ভবতী ছিলেন। তিনি জন্ম দেন সব গ্রহ-নক্ষত্রকে। সন্তানরা চিরকাল মায়ের কাছাকাছি রয়ে যায়, কারণ আকাশ তাঁদের মা। মা-কে ছেড়ে তারা কোথায় যাবে?

এরপর নুটের গর্ভে জন্ম নেয় এক আলোকিত পুত্রসন্তান — সূর্যদেব। আকাশ আলোয় ভরে ওঠে। তৎপর হয় মেঘ, নদী, ও জল। পৃথিবীর বুকে ফুটে ওঠে ফুল, ফলে ভরে ওঠে ফসলের ক্ষেত।

নুট ও জেব চিরকালের জন্য বিরহবেদনার প্রতীক হয়ে রয়ে যান। আকাশ ও পৃথিবীর মাঝে থাকা বায়ুমণ্ডল যেন সকল বিরহী মানুষের দীর্ঘশ্বাস আর চোখের জলের গান দিয়ে পূর্ণ। 

Comments

Popular posts from this blog

দুর্গাপূজা কেন সর্বজনীন উত্‍সব