গণতন্ত্র ও নাগরিক সচেতনতা
আব্রাহাম লিঙ্কন বলেছিলেন, “Democracy is a government of the people, by the people, and for the people” — এটি নিঃসন্দেহে গণতন্ত্রের সবচেয়ে উদার, মানবিক ও নীতিনির্ভর সংজ্ঞাগুলোর একটি। এই সংজ্ঞায় মানুষই কেন্দ্রে — মানুষের দ্বারা, মানুষের জন্য, মানুষের হয়ে শাসনব্যবস্থা পরিচালিত হবে। কিন্তু এই আদর্শিক কাঠামো বাস্তব ক্ষেত্রে সবসময় সত্যি হয়ে ওঠে না। কারণ, লিঙ্কন তাঁর গণতন্ত্রের সংজ্ঞায় যে ‘মানুষ’-এর কথা বলেছেন, সেই মানুষ যদি যথাযথ শিক্ষা, বিচারবোধ ও বুদ্ধিমত্তার অভাবে আক্রান্ত হয়, তবে গণতন্ত্রের প্রকৃতি হয়ে ওঠে সংকটপূর্ণ ও বিকৃত।
একজন অশিক্ষিত
বা অর্ধশিক্ষিত নাগরিক চতুর রাজনীতিবিদের মিথ্যা প্রতিশ্রুতি, ধর্ম বা জাতিগত
উস্কানি, বা তাৎক্ষণিক
লাভের মোহে নিজের ভোটাধিকার প্রয়োগ করলে সেই গণতন্ত্র কি আদৌ "for the people" থাকে? গণতন্ত্র তখন
একরকম সংখ্যার খেলায় পরিণত হয়, যেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠতা মানেই ন্যায় বা যুক্তি নয়, বরং তা হয়ে
দাঁড়ায় এক শ্রেণির মানুষের হাতে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার হাতিয়ার।
লিঙ্কন যেভাবে
গণতন্ত্রকে কল্পনা করেছিলেন, তা ছিল একটি সজাগ, সচেতন এবং সদ্বুদ্ধিসম্পন্ন জনসমষ্টির ভিত্তিতে
গঠিত শাসনব্যবস্থা। সেখানে প্রতিটি নাগরিক রাজনৈতিকভাবে সংবেদনশীল, নৈতিকভাবে সচেতন
এবং তথ্যভিত্তিক সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম। কিন্তু আধুনিক কালের বহু গণতান্ত্রিক দেশে
দেখা যায়, ভোটারদের বড়
একটি অংশই সিদ্ধান্ত নেয় আবেগ, ধর্মীয় উন্মাদনা, গুজব বা স্বল্পমেয়াদি সুবিধার ভিত্তিতে। কেউ কেউ
খাদ্য-সামগ্রী বা টাকার বিনিময়ে ভোট দেন, কেউ আবার সামাজিক মাধ্যমের অপপ্রচারে বিভ্রান্ত
হয়ে ভোটাধিকার প্রয়োগ করেন। এর ফলে গণতন্ত্রের প্রকৃত রূপ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, এবং তা এক সময়
লোকদেখানো বা "elective autocracy"-তে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি করে।
![]() |
জনতা |
তাছাড়া, গণতন্ত্রের জন্য একটি শক্তিশালী ও নৈতিক গণমাধ্যম, জবাবদিহিমূলক প্রশাসন এবং কার্যকর বিচারব্যবস্থা অপরিহার্য। কিন্তু যদি সাধারণ মানুষ এসব প্রতিষ্ঠানের গুরুত্ব অনুধাবন না করে, বরং কুৎসিত প্রচার, সস্তা চমক এবং নেতানির্ভর সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে, তবে গণতন্ত্র একরকম নাট্যশালায় রূপ নেয় — যেখানে ভোট মানে শুধু ক্ষমতার পালাবদল, নীতির নয়।
লিঙ্কন তাঁর
তত্ত্বে মানুষকে গণতন্ত্রের মূল চালিকা শক্তি হিসেবে কল্পনা করেছিলেন, কিন্তু সেই
মানুষের চরিত্র কেমন হবে — তা নির্ধারণ করেননি। মানুষের চরিত্র, তার বিবেচনা ও
বোধশক্তিই যদি দুর্বল হয়, তবে গণতন্ত্র একরকম আত্মঘাতী ব্যবস্থায় পরিণত
হয়। এক্ষেত্রে ফরাসি দার্শনিক রুশো-র ‘General Will’-এর ধারণার কথাও মনে পড়ে, যেখানে জনগণের
সম্মিলিত ইচ্ছাই রাষ্ট্রের ভিত্তি। কিন্তু সেই সম্মিলিত ইচ্ছা যদি দুর্নীতিপরায়ণ, বিভ্রান্ত বা
লোভপ্রবণ হয়, তবে রাষ্ট্রের ভিত্তিও দুর্বল হয়ে পড়ে।
অতএব, গণতন্ত্র টিকিয়ে
রাখতে হলে কেবলমাত্র নির্বাচন নয়, বরং একটি সুস্থ রাজনৈতিক সংস্কৃতি, নৈতিক শিক্ষার
প্রসার, এবং জনগণের
মধ্যে দায়িত্ববোধের চর্চা জরুরি। ভোট কেবল একটি অধিকার নয়, এটি দায়িত্বও
বটে। সেই দায়িত্ব সঠিকভাবে পালনের জন্য চাই রাজনৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত, নীতিসচেতন
নাগরিকসমাজ।
লিঙ্কন হয়তো
তাঁর সময়ের প্রেক্ষাপটে গণতন্ত্রকে একটি আদর্শ রূপে কল্পনা করেছিলেন। কিন্তু
বর্তমান পৃথিবীতে সেই আদর্শ বাস্তবায়নের জন্য শুধু শাসকের সদিচ্ছা নয়, বরং জনগণের
নৈতিক জাগরণই বেশি প্রয়োজন। গণতন্ত্র তখনই সত্যিকার অর্থে মানুষের হবে, যখন মানুষ নিজেই
হবে তার দায়িত্বশীল অভিভাবক — অন্ধ অনুসারী নয়।
Comments
Post a Comment