স্বাধীনতা অন্তরে বাহিরে

দড়ি দিয়ে খুঁটিতে বাঁধা একটি গরু। খুঁটিকে কেন্দ্র করে তার চারপাশে রচিত হয়েছে এক বৃত্তাকার তৃণক্ষেত্র — যেন একটি সীমিত জগৎ, যেখানে সে স্বাধীন, কিন্তু সেই স্বাধীনতা কেবল দড়ির দৈর্ঘ্য পর্যন্ত বিস্তৃত। এই দৃশ্যটি শুধু একটি গরুর নয়, এটি যেন এক প্রতীক — আমাদের জীবনের, আমাদের অস্তিত্বের।

Cow tethered to a peg to graze.

আমরাও যেন সেই খুঁটিতে বাঁধা প্রাণী। জন্মের পর থেকেই আমাদের ঘিরে তৈরি হয় শৃঙ্খল — সামাজিক নিয়ম, পারিবারিক অনুশাসন, সংস্কার, ধর্ম, রাষ্ট্র — সব মিলিয়ে এক অদৃশ্য কিন্তু প্রভাবশালী পরিধি। আমরা চলি, ঘুরি, বাঁচি — কিন্তু সেই চলার গণ্ডি নির্ধারিত অন্য কারও হাতে। এই পৃথিবীতে আমাদের বিচরণ যেন পূর্বনির্ধারিত এক পরিধির মধ্যেই সীমাবদ্ধ

জীবনের পথচলায় আমরা হাসি, কাঁদি, গড়ি ও ভাঙি। কখনও সাফল্যে উদ্ভাসিত হই, কখনও ব্যর্থতায় ক্লান্ত। কিন্তু আমাদের দৌড় সেই দড়ির দৈর্ঘ্য পেরোয় না। কারও দড়ি দীর্ঘ, কারও সংক্ষিপ্ত — কিন্তু দড়ি আছে সবারই। এই সীমাবদ্ধতার মধ্যেই কেউ খুঁজে নেয় গভীর অর্থ, কেউ বা কেবল টিকে থাকার সংগ্রামে ক্লান্ত হয়

তবে, এখানেই শেষ নয়। মানুষ শুধু শরীর নয় — সে মন, আত্মা, চেতনা। দড়ি দিয়ে বাঁধা যায় দেহকে, কিন্তু মন? আত্মার কি কোনও পরিধি আছে? চেতনার কি কোনও সীমানা টানা যায়? মনের স্বাধীনতা আকাশের মতো — যতই বেষ্টনী দাও, সে আপন আলোয় ছড়িয়ে পড়ে। এই গভীর সত্যটিই তো ধ্বনিত হয় লোকগানে:

আমার হাত বান্ধিবি, পা বান্ধিবি —

মন বান্ধিবি কেমনে?
আমার চোখ বান্ধিবি, মুখ বান্ধিবি —
পরান বান্ধিবি কেমনে?
আমার ইচ্ছা বান্ধিবি, সোহাগ বান্ধিবি —
অনুরাগ বান্ধিবি কেমনে?

এই গানের পঙক্তিগুলো যেন অন্তরের মুক্তির আহ্বান। শরীর সীমাবদ্ধ, সমাজনির্ধারিত; কিন্তু আত্মা চিরমুক্ত, ঈশ্বরনির্ভর। যারা হৃদয়ের গভীরে প্রবেশ করতে পারে, তারা জানে — সত্যিকারের স্বাধীনতা বাইরে নয়, অন্তরে। বাইরের দড়ি ছিন্ন না করেও অন্তর্জগতে মানুষ পেতে পারে অনন্ত আকাশ

তাই হয়তো জীবনের আসল সাধনা হল — এই বৃত্তের ভেতরে থেকেও বৃত্তের বাইরে ভাবতে শেখা। দড়ি বাঁধা থাকলেও মন যেন হয় পাখির মতো — যে উড়ে যায় অনন্তের দিকে
, মুক্ত আকাশে, যেখানে নেই কোনও খুঁটি, নেই কোনও দড়ি, কেবল রয়েছে এক বিশুদ্ধ, আধ্যাত্মিক আলো

Comments

Popular posts from this blog

দুর্গাপূজা কেন সর্বজনীন উত্‍সব